জায়গাটি ঢাকার বনগ্রাম লেন। নিম্নমধ্যবিত্ত এই পাড়ায় শিক্ষিত-সংস্কৃতিমনা মানুষের বড্ড অভাব। গান জানা কোনো তরুণীর পক্ষে এ রকম পাড়ায় দিনযাপন সহজ নয়। তেমনই এক বিষণ্ন বিকেলে বনগ্রামের বাড়ির দোতলার ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ান রানু সোম। একটা ফিটন গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামে।
সময়টা ১৯২৮ সাল, বাংলা মাস আষাঢ়। রানুর কথায়, ‘বাঙালির তুলনায় একটু বেশিই স্বাস্থ্যবান ও সুশ্রী এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়, এক মুখ হেসে গায়ের গেরুয়া চাদর সামলাতে সামলাতে আমাকে ঠেলেই প্রায় ঢুকে এলেন ঘরে।’
এই রানু সোম বা প্রতিভা সোম, যিনি পরবর্তী সময়ে প্রতিভা বসু। পৈতৃক নিবাস মুন্সিগঞ্জের হাঁসাড়া। সুসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেই সংগীতশিল্পী হিসেবে যিনি জনপ্রিয়, প্রেমের গান গেয়ে রাতারাতি নাম কিনে ফেলেছেন। গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে বছরে ৬টি রেকর্ড, অর্থাৎ ১২টি গান বেরোয় তাঁর। তত দিনে নজরুলসংগীতেও হাতেখড়ি হয়ে গেছে এবং এখানে-ওখানে নজরুলসংগীত গেয়ে প্রশংসাও পাচ্ছেন।
আর নজরুল ইসলামের গান ও বিপ্লবী কবিতায় তখন সারা বাংলা মাতোয়ারা। যার গলায় সুর নেই, তার মুখেও শোনা যায়, ‘কে বিদেশি বন উদাসী, বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে’। আর ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে’ গাইতে গাইতে ছেলেরা ঢোকেন কারাফটকে।
এই রানু সোমের কথা নজরুল জানতে পারেন গীতিকবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের পুত্র প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের কাছে, যার ডাকনাম ছিল মন্টু। আর মন্টু ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
রানু সোমকে (পরবর্তীকালে প্রতিভা বসু) গান শেখাচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলামের বয়স তখন ২৯ কি ৩০। পুরান ঢাকার বাড়িতে প্রথম দেখায় নজরুলের চেহারার বর্ণনা ‘জীবনের জলছবি’ বইতে রানু এভাবে দিয়েছেন, ‘যৌবন তার চোখে-মুখে, সারাক্ষণ হাসিতে সমস্ত শরীরে নদীর স্রোতের মতো বহমান, বেগবান। সেই বয়সে যারা তাকে দেখেছেন শুধু তাদেরই বোঝানো যাবে কী দুকূলপ্লাবী আনন্দধারা দিয়ে গড়া তার চরিত্র। মস্ত বড় বড় কালো টানা চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রং, সহজ সরল অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা, সবটা মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে। আর তার ধুলোয় লুটিয়ে পড়া গেরুয়া চাদর।’
নজরুলের সেবার (১৯২৮) ঢাকায় আসাও কম চমকপ্রদ ছিল না। প্রতিভা বসুর বর্ণনায়, গড়ের মাঠে খেলা দেখে এক বন্ধুর সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান তর্ক করতে করতে চলে আসেন শিয়ালদহ স্টেশনে। দেখেন ঢাকা মেইল দাঁড়িয়ে আছে। অমনি উঠে পড়েন। সেবার এসে তিনি ওঠেন বন্ধু খ্যাতিমান দাবাড়ু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায়। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে বর্ধমান হাউসের দোতলায় বাস করতেন মোতাহার হোসেন, যেটা এখন বাংলা একাডেমির অংশ। মোতাহার হোসেন নজরুলের চেয়ে বয়সে দুই বছরের বড় ছিলেন এবং সম্পর্ক ছিল ‘তোমা-তুমি’র মতো। ভালোবেসে নজরুল তাঁকে ডাকতেন ‘মোতিহার’ বলে।
ওই আষাঢ়স্য দিবসে (১৯২৮) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রানুকে গান শেখানোর পর পরদিন সকালে নজরুল আবার যান তাঁদের বাড়িতে। কিছুটা অবাক হন রানুও। নজরুল বর্ধমান হাউস থেকে প্রাতর্ভ্রমণ করতে করতে পৌঁছে যান বনগ্রাম। ঢাকার অনেক সংগঠন এ সময় নজরুলকে তাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করত।
রানু সোমের বর্ণনায় নজরুলের কথায়, ‘উঃ কী করে ছেলেগুলো। ওদের পাল্লায় পড়লে উপায় আছে, ঠিক কোথাও না কোথাও ধরে নিয়ে যাবে।’ মূলত তাদের এড়ানোর জন্যই তিনি সকাল সকাল রানুদের বাড়ি গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। আগের রাতে লেখা গান ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, এ কোন সোনার গাঁয়, আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়’ হারমোনিয়ামে সুর তুলে রানুকে শিখিয়ে দেন।
এর আগের বছরই, ১৯২৭ সালে ঢাকায় এসেছিলেন নজরুল ইসলাম। কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর স্মৃতিকথার ‘স্মৃতিপটে নজরুল’ অংশে উল্লেখ করেছেন, ১৯২৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নজরুল ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নামকরণ তখনো হয়নি) ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন। গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জে আসার পথে একটি গান রচনা করেন তিনি। সম্মেলনে ‘খোশ আমদেদ’ নামে উদ্বোধনী গীতি হিসেবে ওই গানটি গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। গানটি ছিল:
‘আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি!
ও চরণ ছুঁই কেমনে দুই হাতে মোর মাখা যে কালি॥
দখিনের হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতী!
শবে’রাত আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥
তালি-বন ঝুমকি বাজায় গা ‘মোবারক-বাদ’ কোয়েলা।
উলসি’ উপচে প’ল পলাশ-অশোক-ডালের ঐ ডালি॥’
মোতাহার হোসেনের কথায়, ‘এই গান শুনে সুরের বিপুল উচ্ছ্বাসে সুধীগণ এমনকি মোল্লা-মৌলবীগণ পর্যন্ত উল্লসিত হয়ে উঠলেন।’ তাদের কথা, ‘কী সুন্দর ইসলামী গান, ঠিক যেন গজল।’ ২৭ ফেব্রুয়ারি এসে ১ মার্চ নজরুল ঢাকা ত্যাগ করেন।
কাজী মোতাহার হোসেন। ঢাকায় এসে নজরুল উঠেছিলেন তাঁর কাছে